জাতি গঠনে যুব সমাজ
ভূমিকা :আমাদের যুব সমাজ জাতির আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল। জাতীয় জীবনে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ, যে কোন আপদকালীন মুহূর্তে যুবসমাজ অগ্রণী এবং সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারে। ‘৫২-তে, ‘৫৪-তে, ‘৬২-তে, ৬৬-তে, ‘৬৯-এ, ৭১- এ এবং ‘৯০-এর উত্তাল দিনে দেশবাসীকে তারা আশা দিয়ে, ভরসা দিয়ে, শক্তি দিয়ে, মেধা দিয়ে, মনন দিয়ে এবং প্রতিভা দিয়ে, প্রেরণা জুগিয়েছে। এ ত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের বর্তমান যুব সমাজ দেশগঠনে স্মরণীয় ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের যুবসমাজের গৌরবদীপ্ত অতীত :
আমাদের যুবসমাজের অতীত অতি গৌরবদীপ্ত। জাতির আপদকালীন বিভিন্ন সময়ে তারা যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে তা অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে,৫৮ সাময়িক শাসনের বিরুদ্ধে, ৭১ মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে সংগ্রামী যুবসমাজ ব্যাপক ভূমিকা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে মনে রাখবে।
বর্তমানে যুবসমাজের কর্মকান্ড :
বর্তমানে যুবসমাজের অবস্থা খুব ভয়াবহ। বর্তমানে আর্থসামাজিক পরিবেসের কারনে যুবসমাজ আজ তারা সন্ত্রাসে, চাঁদা আদায়ে ও হত্যার মত অপরাধমূলক কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। তাদের মধ্যে আজ নৈরাজ্য, অবক্ষয়, হতাশা, ব্যর্থতা ও আশা ভঙ্গের আর্তনাদ ধ্বনিত হচ্ছে। অবশ্য গোটা যুবসমাজ এখন অবক্ষয়মূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে নয়। যুবসমাজধারী মুষ্টিমেয় লোকজন এর সাথে জড়িত। বৃহত্তর যুবসমাজের মঙ্গলের কথা ভেবে এ অবক্ষয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সচেতন যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না জাতীয় জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্মরণীয় অবদান রাখা তাদের কর্তব্য। এ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুইকোটি যুবক-যুবতী বেকার। অথচ যুবক-যুবতীরাই হচ্ছে দেশ ও জাতির প্রাণশক্তি। এরাই হচ্ছে সকল কর্মকান্ডের মূল চালিকাশক্তি ও ভবিষ্যতের কর্ণধার। এ যুবসমাজকে বাদ দিয়ে জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতির কথা ভাবাই যায় না। আজকের বাংলাদেশের বেকার যুবসমাজের চিত্র শুধু উদ্বেগজনক নয়, ভয়ংকারও বটে। এ ভয়ংকার পরিস্থিতিতে সমাজে শুধু যে হতাশা বাড়ছে তা নয়, বরং নানাবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দ্বারা ও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে শান্তি-শৃঙ্খলা, নৈতিহতা ও নিরাপত্তা, বাড়ছে অস্থিরতা ও সামাজিক অপরাধ। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও যুব শক্তিকে আত্নকর্মসংস্থানে উদ্ধুদ্ব করে তুলতে হবে। যুব সমাজের আগ্রহ সৃষ্টি এবং তাদের সাহায্যে ও সহযোগিতার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে দেশের বেকার সমস্যাই শুধু নিরসন হবে তা নয়, সামাজিক অপরাধ, বিশৃঙ্খালা ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে দেশকে বাচাঁনো যাবে।দেশ গঠনে যুবসমাজের ভূমিকা :
যুব সমাজ দেশের সচেতন নাগরিক। দেশের প্রতিটি বিষয়ে জানা-বোঝা, অর্জন এবং মতামত প্রদানের মধ্যে তারা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে গড়ে ওঠে। সততা,আদর্শ, নিষ্ঠা, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ যুবরাই জাতির সেরা সম্পদ। নানা সমস্যা ও সম্ভবনাকে সাথে একাত্না হওয়ার মধ্যে দিয়েই যুবসমাজ জাতিগঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের যে ভূমিকা রয়েছে তা হল-(১) নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা।
(২) সন্ত্রাস, হত্যা এবং অরাজকতা থেকে দূরে থাকবে হবে।
(৩) ধৈর্যশীল হতে হবে।
(৪) শরীরের গঠন ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
(৫) আত্নসচেতন হতে হবে।
(৬) সংর্কীণতা দূর করে বিরাট ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে।
(৭) বেকারত্ব দূরীকরন করে দেশ ও জাতির উন্নয়ন করা।
(৮) প্রশিক্ষনের মাধ্যমে মানব সম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ।
(৯) আত্নকর্মসংস্থানের মাধ্যমে শহরমুখী জনস্রোত এবং গ্রামীন অর্থনীতি ও ভারসাম্য রক্ষা।
(১০) জনশক্তি সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন।
(১১) দেশপ্রেমে যুব সমাজকে উদ্ধুদ্ধ করা এবং স্বেচ্ছামূলক কাজে উৎসাহিত করার মাধ্যমে জাতির উন্নয়ন।
(১২)সাধারন শিক্ষার দিকে বেশি না ঝুঁকে তাদেরকে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এতে তারা দ্রুত কাজ পাবে। বেকারত্বের অভিশাপ তাদের বইতে হবে না। এতে যুব সমাজের দ্বারা জাতির উন্নতি হবে।
(১৩) প্রশিক্ষণ দান :
যুব সমাজকে উপযুক্ত প্রশিক্ষন দিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরী করতে হবে এবং স্ব-স্ব পেশায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পুরুস্কার প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে এতে যুব সমাজ উৎসাহিত হবে এবং একটি উন্নত জাতি আমাদের উপহার দিবে।
(১৪) উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে হবেঃ
তাদেরকে কোন ক্রমেই অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করা চলবে না তাদের প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান ও শ্রদ্ধা কিংবা ভালবাসা দিতে হবে।
(১৫) শিক্ষিতের হার বাড়াতে হবেঃ
আমাদের দেশের শিক্ষার হার মাত্র ৬৫ ভাগ। শিক্ষার হার বাড়িয়ে যুব সমাজকে শিক্ষিত করে দেশ ও জাতির উন্নয়ন করা যাবে।
(১৬)যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর :
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকার যুবক-যুবতীদের একটি আশা ভরসা এবং আত্নকর্মসংস্থানের একটি অন্যতম জায়গা। জাতি গঠনের উন্নয়নের পিছনে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এর ভূমিকা অপরিসীম।
“মানুষ বাঁচে আশায় আর দেশ বাঁচে ভালবাসায়” এ কথা মনে প্রানে আমরা যুবক সমাজ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখব।
(১৭) দেশপ্রেম : দেশের স্বাধীনতা ও র্সাবভৌমত্ব রক্ষায় জীবনবাজি রেখে লড়াই করতে ও তারা পিছপা হয় না। তাদের এই দেশপ্রেমসমগ্র জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করে।
(১৮) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন :জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন সর্ম্পকে নিজে সচেতন হয়ে যুবকরা সাধারন মানুষকে সচেতন করতে পারে। অধিক জনসংখ্যার কুফল সর্ম্পকে তারা জনগনের মধ্যে প্রচার প্রচরনা চালালে সহজেই তারা তাদের পরামর্শ গ্রহন করবে। কারন শিক্ষিত যুব সমাজকেই সকলেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
(১৯) নৈতিক অবক্ষয় রোধ :
যুবসমাজের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেশ একটি ইতিবাচক জাগরন সৃষ্টি হতে পারে। সমস্ত অন্যায়, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে নিজেরা সৎ ও আদর্শনিষ্ঠ হয়ে উঠলে একটি দুর্ণীতিমুক্ত জাতি গড়ে উঠতে পারে।
(২০) নিরক্ষতা দূরীকরণ :
জাতিকে নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে যুবসমাজ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একজন শিক্ষিত যুবক তার পাশে অক্ষর দান করতে পারে। প্রতিটি
(২১) বেকারত্ব নিরসন :
মেধা ও সৃজনশীলতার দ্বারা আত্নকর্মসংস্থানের মাধ্যমে যুবসমাজরা বেকারত্ব নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে এবং জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
(২২) সমাজকল্যাণ :
দেশের যেকোন দুর্যোগে যুবসমাজ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা, প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে দেশ ও জাতি উন্নতি সাধন হয়।
(২৩) অর্থনৈতিক উন্নয়ন : কৃষিতে আধুনিকপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা রপ্ত করে দেশে শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে তারা নিজেদের উদ্যোগে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা, হাঁস-মুরগি, পশু ও মৎস চাষ করে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে পারে। এভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন হবে।
(২৪) সাংস্কৃতিক জাগরন :
জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশে যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সাংস্কৃতিক জাগরন ঘটিয়ে তারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
(২৫)বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন :আমাদের দেশের যুবক-যুবতীরা দেশের বাহিরে গমন করে একদিকে যেমন দেশের চাকা সচল রাখছে তেমনি দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে পাঠাচ্ছে ।
উপসংহার :
সচেতন যুবসমাজে যদি উপরোক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য পরম নিষ্ঠার সাথে পালন করে এবং নিজেদেরকে আত্নসচেতন, স্বয়ম্ভর করে গড়ে তোলে, তবে দেশ গঠনে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। বস্তুত সংগ্রামী যুবসমাজ যদি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ নিষ্ঠা ও প্রযত্নের সাথে সম্পন্ন করে এবং আমাদের যুবকদের অতীত গৌরবদিপ্ত কর্মকান্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের গড়ে তোলে তবে আগামি দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় হাতিয়ার হিসেবে তারা চির পরিচিত হবে। আমাদের দেশের মত স্বল্প শিক্ষিত উন্নয়নশীল দেশে যুবসমাজেই সকল আশা-ভরসার স্থল। মানব কল্যানে উদ্ধুদ্ধ হয়ে প্রতিটি যুবক-কে দেশ ও জাতির প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালনের সচেষ্ট হয় তবেই জাতিয় জীবনে আসবে সামগ্রীক মুক্তি।
(অসমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন