শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫

জীবনের উৎপত্তি ও বিবর্তন





জীবনের উৎপত্তি ও বিবর্তন


আধুনিক জীববিজ্ঞান বলে, কোষ হচ্ছে জীবনের মূল একক, আর জীন হল বংশগতিবিদ্যার মূল একক। আর বিবর্তন হল একমাত্র প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির জীব সৃষ্টি হয়। বিবর্তনে একমাত্র প্রধান কারণ হচ্ছে অভিযোজন ক্ষমতার ত্রুটিপূর্ণ আচরণ। তবে জীব-রসায়নও কম দায়ী নয়। আসলে জীবদহে প্রতিনিয়ত চলছে  Carmichael reaction যার ফল সরুপ পরিবর্তত হচ্ছে জিনোমের সিকুয়েন্স। আসলে জীব রসায়ন বা প্রাণরসায়ন হচ্ছে জীবনের  রসায়ন নিয়ে  বিজ্ঞানের যে শাখায় আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা করা হয় তাই হল প্রাণরসায়ন বা জীবরসায়ন।

উদ্ভিদবিজ্ঞান বা উদ্ভিদ-জীববিদ্যা হচ্ছে জীববিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যা জীবন্ত ও জীবাশ্ম  উদ্ভিদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণ সংক্রান্ত কাজ করে থাকে। আণবিক জীববিজ্ঞান এমন শাখা যেখানে সমস্ত জীবিত বস্তুর প্রধানতম অণুসমূহ যথা নিউক্লিয়িক অ্যাসিড ও প্রোটিন-এর গঠন ও কাজ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।যার থেকে বেরিয়ে আসে নতুন ভেরিয়েশনের জিনতাত্বিক নতুন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য।  জীববিজ্ঞান একটি উপশাখা যেখানে প্রজাতির উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা হয়। আর যেখানে জীবিত অর্গানিজমের বিস্তৃতি, বিন্যাস ও প্রাচুর্য এবং এসব অর্গানিজমের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ও পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের সাথে এদের অন্ত:ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয় তাই পরিবেশবিজ্ঞান।আণবিক জীববিজ্ঞান, যাতে জীবপদার্থবিজ্ঞান ও জীবরসায়ন অন্তর্গত শাখা থেকে আধুনিক জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক অবদানগুলি এসেছে। সমস্ত জীবিত বস্তুর প্রধানতম অণুসমূহ যথা নিউক্লিয়িক অ্যাসিড ও প্রোটিন -এর গঠন ও কাজ সম্পর্কে এখন আমরা অনেক কিছু জানি। বংশগতির কৌশল নির্ধারণ ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান আবিষ্কার।১৯৭০-এর দশকে এসে জীববিজ্ঞানের একটি অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাখার কেন্দ্রীয় শাস্ত্র হল বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান, যাতে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের অবদান বহুদিন পরে যথাযথ মর্যাদা পায়। জীবসমষ্টি বংশগতিবিদ্যা (Population genetics), যেখানে জীবসমষ্টিগুলির ভেতরে জীনের পরিবর্তন গবেষণা করা হয়, এবং বাস্তুবিজ্ঞান, যেখানে প্রাকৃতিক আবাসস্থলে জীবসমষ্টির আচরণ গবেষণা করা হয়, ১৯৩০ -এর দশক থেকে শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক চার্লস রবার্ট ডারউইনের দ্বি-শততম জন্মবর্ষ
বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিভিন্ন অঙ্গনে উনিশ শতকে যে সব তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়, বিবর্তনবাদ তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মতাত্ত্বিক দর্শন অনুসারে অনাদি অনন্তকাল থেকে বিরাজমান পরমেশ্বর এক আদেশবলে সৃষ্টি করেন এ জগৎ ও জীবকুল। যেমন, উপনিষদে আছে পরমেশ্বর চিন্তা করলেন ‘একেলা ন রমেত’ (আমি আর একা থাকব না), এক থেকে বহু সৃষ্টি করবো। ফলে তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। ইহুদি ও খিস্টীয় ধর্ম মতেও এ ধারণার সমর্থন রয়েছে। যেমন, স্রষ্টার ইচ্ছা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত জগৎসংসার। এ কাহিনী বিবৃত বাইবেলের আদি পর্বে। ওখানে বলা হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছায় শূন্য থেকে প্রথমে আলোর এবং তার পর ছ’দিন ধরে ক্রমান্বয়ে গ্রহ নক্ষত্র উদ্ভিদ প্রাণী এবং সর্বশেষে আদিমানব আদমের সৃষ্টি। আদমের অস্থিপঞ্জর থেকে সৃষ্টি করা হয় ঈভ বা হাওয়াকে। ছ’দিনে সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করে সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নেন। সেদিনের স্মরণেই খ্রিস্টানরা রবিবারে সাপ্তাহিক বিশ্রাম নেয়।
বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অনুপস্থিতিতে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাধান্যের ফলে মধ্যযুগে অবশ্য জগৎকে ব্যাখ্যা করা হয় স্থির নিশ্চল বলে। কিন্তু আধুনিক যুগে বিবর্তনের ধারণা আবার নতুন করে বিস্তার লাভ করে। যেমন, ডেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০), লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) ও কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) প্রমুখ আধুনিক দার্শনিকদের চিন্তায় বিবর্তনের ধারণা কোন না কোনোভাবে উপস্থিত ছিল। পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে প্রাণীকুল কীভাবে নিম্নতর পর্যায় থেকে ক্রমশ উচ্চতর পর্যায়ে বিবর্তিত হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে ফরাসী প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ল্যামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এসব মতের সূত্র ধরেই জীব ও জগতের বিবর্তন ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদ চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২)।
কিন্তু আধুনিক জীববিজ্ঞান এই আকস্মিক সৃষ্টিবাদের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে এবং এর স্থলে প্রবর্তন করে বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের ধারণা। এ মতে, জগৎ ও জীবনে প্রতিনিয়ত যে সব ঘটনা ঘটে সেগুলোর কোনোটিই সম্পূর্ণ নতুন নয়; প্রতিটি ঘটনাই তার পূর্ববর্তী ঘটনা ক্রমবিকাশের ফল। জগতের অগণ্য জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ তথা সব জৈব ও অজৈব সত্তা এক সহজ সরল আদিম অবস্থা থেকে ক্রমবিকশিত হয়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। পরিবেশ  ক্রমশ অনুকূল হয়ে ওঠে এবং আর্বিভাব ঘটে রকমারি রাসায়নিক পদার্থের। এ প্রক্রিয়ায়ই উপযুক্ত আবহাওয়া, বায়ু ও পানির আবির্ভাবের ফলে ক্রমশ উদ্ভব ঘটে উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রাণীর। শুরুতে মূল পদার্থিক ও রাসায়নিক উপাদানগুলো ছিল সরল কিন্তু এলোমেলো অবস্থায়। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আস্তে আস্তে এগুলো সুশৃঙ্খল জটিল রূপ ধারণ করতে থাকে। বিবর্তন মানে সরল থেকে যৌগিক, বিশৃঙ্খল থেকে সুশৃঙ্খল এবং অনুন্নত থেকে উন্নত অবস্থায় ক্রমিক বিকাশ বা উত্তরণ। এ বিবর্তন ধারার বিভিন্ন স্তর পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ধারাবাহিক অনবচ্ছিন্ন। জগতের সবকিছুই প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল। এখানকার কোনোকিছুই সম্পূর্ণ নতুন নয়, সবই পূর্ববর্তী বস্তু ও ঘটনার ক্রমবিকাশের ফল। বিবর্তনবাদের এ বক্তব্য ব্যাপক সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করে উনিশ শতকে। তখন থেকে সৃষ্টিবাদের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। মানুষসহ বিভিন্ন জীবজন্তু কীভাবে বিবর্তিত হয় তার এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন চার্লস ডারউইন। বিবর্তনবাদে ডারউইনের অবদান প্রধানত জীবজগৎকে কেন্দ্র করে। শৈশব থেকেই উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। পরবর্তীকালে তিন পড়াশোনাও করেন। এ বিষয়েই। ছাত্রজীবন শেষ করে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন একদিন তার পছন্দ করা বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করার এক বিরাট সুযোগ আসে। এইচএমএস বিগল নামক একটি জাহাজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কাজে বিশ্বপরিক্রমায় বের হয় এবং ডারউইন তাতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী হিসাবে একটি চাকরি পান। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ঐ জাহাজে করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত জৈব উপাত্ত নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন।বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন । ডারউইনের মতে, পৃথিবীর জীবজন্তু বর্তমানে যে যে অবস্থায় আছে, শুরুতে সে অবস্থায় ছিল না। এক আদিম অপরিপক্ক অবস্থা তেকে ক্রমিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা বর্তমানের অপেক্ষাকৃত জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রকৃতি এক বিরামহীন সংগ্রামে নিয়োজিত। যারা সর্বাধিক যোগ্য তারাই এ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকে। যারা দুর্বল এবং যারা পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম, তাদের বিলুুপ্তি অনিবার্য।
এ মতবাদের মূল অর্থ এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার। যে বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে, মানবজাতিও তার অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মধ্যেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম অব্যাহত এবং মানুষের বেলায়ও শক্তিশালীরাই সংগ্রাম জয়ী হয়। এবং এ বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় মানুষের দৈহিক ও মানসিক প্রকৃতিতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটে থাকে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে। ডারউইন এই নিশ্চিন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে, মানুষ এক বানর ও মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষণীয়, তার মূলেও রয়েছে সর্বজনীন বিবর্তননীতির প্রভাব। বেঁচে থাকার সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধিতে এমন অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যার ফলে সে পবিেশের প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে জয়ী হতে পেরেছে।
কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে সরিয়ে এবং সৌরজগতের এটি গ্রহে পরিণত করে মানুষকে যেমন সব রকমের জ্যোতির্বিদ্যাকে কেন্দ্র্রিয়তা ও গুরুত্ব থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদেও তেমনি অপরাপর যেকোনো প্রাণীর ন্যায় মানুষও এক আদি সরল অবস্থা থেকে উদ্ভূত এবং অন্যান্য প্রজাতির ন্যায় মানুষও ক্রমিক বিবর্তনের মধ্যমে তার নিজস্ব চেষ্টায় বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
বলা বাহুল্য, ডারউইনের বিবর্তনবাদী মত খ্রিস্টধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বেও বিরোধী। ডারউইনের মতে, জগতে মানুষের কোনো বিশেষ সুুবিধাজনক অবস্থান নেই, এবং জাগতিক ব্যাপারে বিধাতার হস্তক্ষেপের প্রশ্ন ওঠে না। এ মতের প্রভাব বাইবেল বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে অনেকেই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শুরু করে এবং এভাবে ধর্মীয় ব্যাপারাদি নিয়ে জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। ডারউইনেরও প্রায় তিনশো বছর আগে কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও প্রমুখ বিজ্ঞানী নতুন ধর্মবিরুদ্ধ মত প্রচার করে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ মত নিয়ে তুমুল মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এর তীব্র নিন্দা করে।
তবে ডারউইনের সময় থেকে বিজ্ঞানীরা যেসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন তাতে বিবর্তনবাদী অনুমান সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা আজ সাধারণভাবে এ মতকে সত্য বলে গ্রহণও করেছেন। কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিদ্যা যেমন এর ঘোষণার পঁচাত্তর বছর পরে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল, ঠিক তেমনি আজকের দিনের মানুষও ডারউইনের মতকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। তবে একথা ঠিক যে, কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মত আর ডারউইনের জৈব বিবর্তনবাদ, এ দুয়ের কোনোটিই আজও সব মহলে সমানভাবে গৃহীত ও আদৃত নয়। তাই দেখা যায়, বিবর্তনের গোটা ধারণাটিকেই আজও কেউ কেউ সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
বিবর্তনবাদ আজ একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। আর এর পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণও রয়েছে প্রচুর। এ মত জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ যুক্তিপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সৌরমন্ডল ও নক্ষত্রপুঞ্জের বর্তমান অবস্থা লক্ষ-কোটি বছরের ক্রমবিবর্তনের ফল। সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের শক্ত হওয়ার এবং পৃথিবীর একটা নিরেট অবস্থা ধারণের এবং পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ও লোকালয় গড়ে ওঠার জন্য সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। মাটির বিভিন্ন স্তর পরীক্ষা করে ভূবিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আমাদের এই ধরিত্রী একটি আদিম তরল অগ্নিময় অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কঠিন অবস্থা ধারনা করেছে।
মাটির নিচের বিভিন্ন ভূস্তরে কিছু অধুনালুপ্ত প্রাচীন জীবের শিলীভূত নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, বর্তমান প্রাণীকুল সেসব প্রাচীন প্রাণীরই বিবর্তিত রূপ। আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভাষাও অনুরূপ। বর্তমানে আমরা যেসব জীবজন্তু দেখছি তাদের উৎপত্তি আদিকালের জীবজন্তু থেকে। সেদিনের জীবজন্তু ছিল ভিন্নতর আকার ও অবয়বের, এবং তারা বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। মানুষের বেলায়ও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। বর্তমানে আমরা মানবজাতির যে অবস্থা দেখছি তা হঠাৎ করে এই রূপ ধারণ করেনি। এখন আমরা মানুষের যেরকম দেহ ও মন প্রত্যক্ষ করছি, আদিযুগের মানুষের দেহ ও মন তেমনটি ছিল না। কোনো জীবজন্তুই সবসময় একরকম থাকে না। জীবজগতের বিভিন্ন জাতি-প্রজাতি যেমন চিরকাল এক অবস্থায় থাকে না, তেমনি সমাজ ও সামাজিক অনুশাসনও পূর্বাপর একরকম থাকে না। সমাজবিজ্ঞানীর মতে, মানুষের যেসব সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, মূল্যমান ও মূল্যবোধ সেগুলোও এক ক্রমিক পরিবর্তনধারা বা ক্রমবিকাশের ফল।
বিবর্তনের মূল প্রকল্পটিতেও ডারউইনের সময় থেকে ক্রমশ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। জীবনসংগ্রাম ও যোগ্যতমের টিকে থাকার মাধ্যমে বিবর্তনকে সুষ্ঠুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কি না এবং বিবর্তন ব্যাখ্যায় অন্য কেনো নতুন কিছু অবতারণার প্রয়োজন আছে কি না, এ নিয়ে আজও প্রশ্ন উঠেছে। বিবর্তনের নিরবচ্ছিন্নতা সম্বন্ধেও কেউ-কেউ যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, বিবর্তন-প্রক্রিয়া সুসংবদ্ধ ও ক্রমিক অগ্রগতির নির্দেশক নয়, বরং এর মধ্যে প্রায়শই এমন কিছু আকস্মিক পরিবর্তন দেখা যায় যেগুলো বিবর্তনের ক্রমিক ও ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্যকে বিঘ্নিত করে।
যাইহোক, জগৎ ও জীবনকুলের বিবর্তনাবাদী ব্যাখ্যা ধর্ম ও বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানের বেলায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে, নীতিবিদ্যার চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণায় বিবর্তনবাদের প্রভাব যুগান্তকারী। এ মতে, অতীতের নীতিবিদরা যেসব স্থির ও অপরিবর্তনীয় বিধি-নিয়মের কথা বলেছিলেন সেগুলো আসলে তেমন নয়। যেমন, কান্টের দৃষ্টিতে যেসব নৈতিক নিয়মছিল অপরিবর্তনীয় ও প্রাকসিদ্ধ বিবর্তনবাদের প্রভাবে সেগুলোকে দেখা হয় স্বাভাবিক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে। বিবর্তনবাদের প্রভাবে অনপেক্ষ নৈতিক বিশ্বাসের স্থলে আপেক্ষিকতা ক্রমবর্ধমানা গুরুত্ব লাভ করতে পারে। জীবনসংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সবচেয়ে উপযুক্তদের বেঁচে থাকার ডারউইনীয় ধারণা শিক্ষিত মহলে ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে। তখন এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, মানুষসহ সব জীবজন্তুই প্রাকৃতিক কার্যকারণ নিয়মের আওতাধীন, এবং এ নিয়মেই তারা কোনো চেতন সত্তা কিংবা ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়াই ক্রমবিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। এ মতে, মানুষের আচরণের শুভাশুভ বিচারের মানদণ্ড খুঁজতে হবে প্রকৃতিজগতেই, কোনো অজানা অচেনা অতিপ্রাকৃত সত্তায় নয়। নৈতিক মূল্যবোধকেও বিচার করতে হবে প্রচলিত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই।
জগতের এই নতুন বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা একদিকে কর্মের ক্ষেত্রে, অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বেলায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে অর্থনীতির পাঠ ও গবেষণায় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির বিকাশের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, এবং আঠারো শতকের অর্থনীতিবিদেরা যেসব স্থির ও অপরিবর্তনীয় নিয়মের কথা বলেছিলেন সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এক কথায় অর্থনীতিকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে এনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের আওতাভুক্ত করা হয়। নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রের অনুরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কান্টের দৃষ্টিতে যেসব নিয়ম ছিল অপরিবর্তনীয়, বিবর্তনবাদের প্রভাবে তাদের দেখা হয় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসাবে। অনপেক্ষ নৈতিক বিশ্বাসের স্থলে আপেক্ষিকতার ক্রমবর্ধমান গুরুত্বলাভ করে।
বিবর্তনবাদ ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ও গবেষণাকে উৎসাহিত করে। ইতিহাসকে মনে করা হয় সেসব মানুষের মনের চাবিকাঠি হিসাবে যারা বস্তু ও ঘটনাকে দেখেন তাদের উৎপত্তি ও বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে। উনিশ শতকের ইতিহাসবিদরা যখন পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেন এবং মানুষ ও তার প্রতিষ্ঠানাদির বিবেচনায় ডারউইনের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুকরণ করলেন, তখনই সম্পূর্ণ হলো অতিপ্রাকৃতের অক্টোপাস থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া। সমাজবিজ্ঞানের পাঠ ও অধ্যয়নেও বিবর্তনবাদ সৃষ্টি করে এক নতুন প্রেরণা। প্রাণীদেহের গতিপ্রকৃতি যেমন তাদের পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, মানুষকেও তেমনি দেখা হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির অংশ হিসাবে। সমাজবিজ্ঞানীরা ক্রমশ উপলব্ধি করলেন যে, এসব প্রতিষ্ঠান এক অবিরাম পরিবর্তনধারার অধীন। এরা স্থির হয়ে নেই; সুতরাং সমাজবিজ্ঞানে অনপেক্ষ নিয়মের কোনো স্থান নেই। আমরা শুধু সমাজের বর্ণনা ও শ্রেণীবিভাগ করতে পারি, কিন্তু কোনো অবস্থায়ই পূর্ণাঙ্গতার দাবি করতে পারি না।!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন